আজ থেকে দুই মাস পদ্মা- মেঘনায় মাছ ধরা বন্ধ

আনোয়ারুল হক ॥

ইলিশ রক্ষায় মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২টা থেকে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনায় দুই মাস (মার্চ ও এপ্রিল) মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। এসময় পদ্মা-মেঘনা নদীর অভয়াশ্রম এলাকায় জালসহ যে কোনো সরঞ্জাম দিয়ে জাটকাসহ সকল ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকবে।

জানা গেছে, সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, এ সময় কোনো মাছ ক্রয়-বিক্রয়,পরিবহন ও মজুদ সর্ম্পূণ নিষিদ্ধ থাকবে। আইন অমান্য করে কেউ মাছ আহরণ করলে তার বিরুদ্ধে মৎস্য আইনে দুই বছর কারাদণ্ড, ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার পদ্মা-মেঘনা নদীর ষাটনল থেকে হাইমচরের চরভৈরবী এলাকা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটারের নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেরা নদীতে নামতে পারবেন না। ৪৪ হাজার ৩৫ জন কার্ডধারী ও নিবন্ধিত জেলে রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মঙ্গলবার সকাল থেকে মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে দল বেধে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা। তীরে নোঙর করে ফিশিংবোট, ট্রলার থেকে ইঞ্জিন, জালসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম নিরাপদ স্থানে রেখে দিচ্ছেন। আবার কোনো কোনো জেলে জাল, নৌকা পরিস্কার করছেন। জালের ছেড়া অংশ জোড়া-তালি দিচ্ছেন। এসব সরঞ্জাম নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। তবে দুই মাস অভিযান থাকায় তাদের এনজিওর কিস্তি টাকা দিতে পারবে না বলে জানিয়েছেন ।

চাঁদপুর সদর উপজেলার বহরিয়া এলাকার জেলে হানিফ গাজী জানান, সরকার দুই মাস অভয়াশ্রম অভিযান দেয়, আমরা পালন করি। নদীতে অভয়াশ্রমে জাল ফেলি না। সরকার আইন করেছে ,আমরা তা মেনে চলি। আমার প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকার কিস্তি আছে । এই দুই মাসে কিভাবে কিস্তি চালাবো, আমি বলতে পারছিনা। এতে আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। সরকার চাল দেয় প্রতি মাসে ৪০ কেজি। এই চালে আমার সংসারে কিছুই হয় না। আমার প্রতি মাসে ৮০ কেজি চাল লাগে। তাছাড়া চালের সাথে কি না লাগে? মা-বাবা ,সন্তান আছে। সন্তানদের পড়ালেখা আছে। এই দুই মাস চলতে অনেক কষ্ট হবে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত আবেদন করছি, আমাদের পূর্ন:বাসন সরকার যেন আরো বৃদ্ধি করে দেয়।

আরেক জেলে আমির হোসেন শেখ জানান, আমরা জাটকা রক্ষায় সরকারের দেয়া অভিযান মেনে নিয়েছি। আজ আমরা নদী থেকে জাল উঠিয়ে ফেলেছি। দুই মাস অভিযান উপলক্ষে সরকার জেলেদের গরু-ছাগল, সেলাই মেশিন দেয়। কিন্তু আমি পাই না। তবে শুধু চাল পাই। অভিযানের সময় আমরা প্রায় দেখি অন্য জেলেরা জাটকা ধরে। এরা কারা তা জানিনা।
স্থানীয় জেলে মো: সলেমান জানান, আজ রাত থেকে অভিযান শুরু হবে। দুই মাসের জন্য জেলেরা নদীতে মাছ ধরবে না। কোস্ট গার্ড পুলিশ একটু কঠোরভাবে ডিউটি করলে অসাধু জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে পারবে না। আমাদের জেলেরা এসময়ে একুট অসহায় অবস্থায় থাকে। যদি সরকারের হাত একটু বাড়িয়ে দেয় আমাদের দিকে তাহলে ভাল থাকব।

চাঁদপুর মাছ ঘাটে আসার জেলে আলী হোসেন জানান, সরকার আমাদেরকে ৪ কেজি করে চাল দেয়। কিন্ত চালের বস্তায় ৪০ কেজি চাল থাকে না । মাত্র ২৮-৩০ কেজি চাল হয়ে থাকে। এই চাল দিয়ে আমাদের জীবন চলে না। সংসার চালাতে হলে তেল,লবন, তবকারি লাগে। বাচ্ছাদের পড়ালেখার খরচ, কিস্তি আছে। এই সময়ে যদি কিস্তিগুলো সরকার বন্ধ করে দিত, তাহলে অনেক ভালো হতো।

তিনি আরও বলেন,মানুষ মরে থাকলেও কিস্তি দেয়া বন্ধ যায় না। অবসর থাকলে কিভাবে কিস্তি দিবে।নদী ছাড়া উচুতে এমন কোন কাজ নাই কিস্তির টাকাগুলো পরিশোধ করব। এই সময়ে যারা জাটকা ধরবে তাদের জেল, ফাসি দেয়া হোক, এতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এ সময়ে নদীতে অন্য প্রজাতের মাছগুলো ধরার অনুমতি দিলে ভাল হতো।

আরেক জেলে সজীব জানান, এই দুই মাসের অভিযানে সরকার চাল দেয়। এতে লাভ হয় না। বাচ্ছাদের পড়ালেখার খরচ, কিস্তি আছে। কিস্তির টাকা আমাদের দেয়া এই দুই মাস বন্ধ রাখলে আমরা মোটামুটি ভালভাবে চলতে পারতাম।

জেলা কান্ট্রি ফিসিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম মল্লিক বলেন,চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার পদ্মা-মেঘনা নদীর ষাটনল থেকে হাইমচরের চরভৈরবী প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত অভয়াশ্রমের অন্তভুক্ত। আমরা নিজের জাল ও নৌকাগুলো বন্ধ করে দিয়েছি, এবং অন্যন্য নৌকাগুলো আজ বন্ধ হয়ে যাবে। রাত ১২টা ১ মিনিটের পর থেকেই এই অভিযান শুরো হবে। জেলেদেরকে সচেতন করেছি। তারা যেন নদীতে না নামে জাল ও নৌকার মালিদের পাশাপাশি জেলেদের সচেতন করেছি। আমরা নিজেরা আইন মেনে চলব এবং অন্য জেলেরা এজন্য আইন মেনে চলে এজন্য তাদের উৎসাহিত করেছি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান জানান,জাটকা সংরক্ষণ অভিযান দুই মাস (মার্চ ও এপ্রিল) অভয়াশ্রমে পরিচালিত হবে। অভিযান পরিচালনায় সময় মৎস্য কর্মকর্তা, কোস্টগার্ড,নৌ পুলিশসহ টাস্কফোর্সের সদস্য দায়িত্ব পালন করবে।অভিযান পরিচালনার জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রচার প্রচারনা ব্যপকভাবে চলছে। অভয়াশ্রম ও জাটকা রক্ষা কার্যক্রম উপলক্ষে জেলেদের জন্য এই দুই মাস ভিজিএফের বরাদ্দকৃত চাল ইতোমধ্যে পেয়েছি। তাদের মাঝে চাল বিতরণ করা হয়েছে। যেহেতু তারা চাল পেয়েছে। আশা করছি,তারা আমাদের জাটকা রক্ষায় সহযোগিতা করবে।

নৌ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানান,এবছর মা ইলিশ সর্ব্বোচ সংখ্যাক ডিম পেরেছে। গবেষকরা গবেষনা করে দেখেছে ৫০% মা ইলিশ ডিম ছাড়তে সমর্থ হয়েছে। যার জন্য নদীতে জাটকার পরিমাণ অনেক বেশি বৃদ্ধ পেয়েছে। মার্চ ও এপ্রিল দুই মাস জাটকা সংরক্ষরণ অভিযান চলবে। নদীতে শুধু জাটকাই না সকল ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। নৌ পুলিশ অন্যান্য বছবেরর ন্যায় গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করবে। আমরা এখানে অধিক সংখ্যাক পুলিশ মোতায়েন করবো। আমরা আশা করি জাটকা সংরক্ষরণ অভিযান সফল হবে। এবং নদীতে ইলিশ বৃদ্ধ পাবে।

শেয়ার করুন: