জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে : নির্বাহী প্রকৌশলী আবু মুসা মোঃ ফয়সাল

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চাঁদপুরের আয়োজনে চাঁদপুরে জলবায়ু নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশার জনসাধারণের অংশগ্রহণে ‘করোনাকালে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন : অংশীজনের ভূমিকা’ শীর্ষক ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভা গতকাল ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সনাক সভাপতি শাহানারা বেগম।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু মুসা মোঃ ফয়সাল বলেন, জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়নে জনগণের সাথে আলোচনা করা এবং তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু সমস্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একটি সমস্যা। শুধু জলবায়ুর কাজে নয় যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজে যদি সুধিজনের অংশগ্রহণ থাকে তাহলে কার্যক্রম বাস্তবায়নে অনেক সুবিধা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তিনি আরও বলেন, উপকূলীয় এলাকায় পানির লেয়ারগুলোতে এখন আর্সেনিক পাওয়া যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডিপ লেয়ারগুলোতেও লবনের মাত্রাটা বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর তিনভাগের মধ্যে দুইভাগই পানি। যার মধ্যে ১.২% বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাধারণ জনগণ যাতে কোন ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমরা যেন কোনো হুমকির সম্মুখীন না হই সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখার আহ্বান জানান। তিনি এমন একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করায় সনাককে ধন্যবাদ জানান।

সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড-চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেফাত জামিল বলেন, জলবায়ু কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্র্তনের ফলে বাংলাদেশের মধ্যে চাঁদপুর জেলা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। ভারত বাংলাদেশের বেশিরভাগ পানিই চাঁদপুরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় চর পরার কারনে নদীর গতিপথ সরে যাচ্ছে। আমরা ২০১৪ সালে জলবায়ু ফান্ডে কাজ করেছি। চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ করার জন্য ইতিমধ্যে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে আমরা পরিবেশকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। অনেক সময় আমরা নিজের অজান্তেই পরিবেশের ক্ষতি করে ফেলছি। তবে যে কোনো প্রকল্পের কাজে এখন সুশাসন অনেক বেশি। অনিয়ম করলে অ্যাকশনও হচ্ছে। যেকোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে সে এলাকার জনসাধারণের মতামত নেওয়া খুবই জরুরি। আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে।

সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁদপুরের সহকারী পরিচালক নাজিম হোসেন শেখ বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন পরিবেশের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আজকের মতবিনিময় সভাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটা চমৎকার উপস্থাপনা দেখলাম। উপস্থানায় জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। সাধারণ জলবায়ু সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। তাদেরকে জানানোর জন্য প্রকল্প এলাকায় প্রকল্পের তথ্য সম্বলিত একটা সাইনবোর্ড দেওয়া। আমি মনে করি জলাবায়ুতে ক্ষতিগ্রস্থ খাতগুলো নিয়ে কাজ করা দরকার। যেখানে কাজ হবে সেখানকার সাধারণ জনগণই তাদের এলাকার সমস্যাগুলো বুঝতে পারে। তাই কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে জনগণের মতামত নিতে হবে। সাধারণ জনগণকেও এব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। আমি মনে করি সনাক-টিআইবি জলবায়ু প্রকল্পে পরামর্শ ও মনিটরিং করা দরকার।

স্বাগত বক্তব্যে সনাকের সাবেক সভাপতি কাজী শাহাদাত বলেন, করোনাকালে জলবায়ু বিষয়ক সুশাসন : অংশীজনের ভূমিকা শীর্ষক আজকের ভার্চুয়াল আলোচনা সভাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। করোনার বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের সতর্কতার একটি অগ্রণীরুপ। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা খুবই হতাশাগ্রস্ত ও চিন্তিত। তারপরও আমরা ভার্চুয়ালী সনাকের দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম অত্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন করছি। করোনাকালে অনেক কিছুতেই অনিচ্ছাকৃত সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। আবার অনেক সেক্টর আমরা দেখেছি ইচ্ছাকৃতভাবে সুশাসন বিঘ্নিত করছে। তবে আমরা আশাবাদী এই করোনাকালে চাঁদপুরে জলবায়ু কার্যক্রমে সুশসান নিশ্চিত হবে। আমরা প্রত্যাশা করছি আজকের আলোচনার মাধ্যমে জলবায়ু ইস্যুতে মূল বিষয়গুলো উঠে আসবে। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

টিআইবির সিভিক এনগেজমেন্ট বিভাগের কো-অর্ডিনেটর কাজী শফিকুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমরা প্রত্যেকে প্রাত্যহিক জীবনে প্রভাবিত হচ্ছি। জলবায়ুজনিত সমস্যা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তন কিভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কারা এজন্য দায়ী, কারা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, জলবায়ু অর্থায়ন কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে, জনগণের অংশগ্রহণ রয়েছে কিনা, অবাধ তখ্য প্রবাহ নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সাথে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা, জনগণের চাহিদার প্রতিফলন হচ্ছে কিনা, এ বিষয়গুলোর দিকেও নজর দিতে হবে। প্রতিটি জলবায়ু প্রকল্প যাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনগণের মতামতের আলোকে করা হয় সেজন্য তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

করোনাকালে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন : অংশীজনের ভূমিকা ও করণীয় শীর্ষক ধারনাপত্র উপস্থাপন করেন, টিআইবি চট্রগ্রাম ক্লাস্টারের ক্লাস্টার কোঅর্ডিনেটর মোঃ জসীম উদ্দিন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর কারণ ও প্রভাব, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ, জলবায়ু তহবিল ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিতে টিআইবি’র অভিজ্ঞতা ও উদ্যোগসমূহ, দুর্যোগ মোকাবেলায় সুশাসন ও চ্যালেঞ্জ: টিআইবি’র অভিজ্ঞতা, জলবায়ু তহবিল ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিতে টিআইবি কোর এক্টরদের ভূমিকা ও করনীয় এবং জলবায়ু তহবিল ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিতে অংশীজনের ভূমিকা ও করনীয় বিষয়ে আলোকপাত করেন।

সনাকের সাবেক সভাপতি সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ মোশারেফ হোসেনের সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনায় চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সামছুদ্দোহা বলেন, ২০১০ ও ২০১৭ সালেই চাঁদপুর পৌরসভার জলবায়ু তহবিলের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমরা জলবায়ু তহবিলের টাকা সঠিকভাবে ব্যয় করেছি। জলবায়ু ফান্ডের কাজে কর্তৃপক্ষ বেশ প্রশংসাও করেছেন। আপনারা জানেন, জলবায়ু তহবিল দিয়ে চাঁদপুরে ব্যাপক হারে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। যার ফলে শহরে জলাবদ্ধতা অনেক কমেছে। জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যেকটি প্রকল্প দেওয়া হয় সেই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সুশাসন নিশ্চিত করা দরকার। জেলা পরিষদ থেকে জলবায়ু ফান্ডের আওতায় ২০০ ডিপ টিউবওয়েল দেওয়া হয়েছে। সেই প্রকল্পটিও ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বিসিটিটিএফ-এর অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিসিটিটিএফ কাজগুলো করার ক্ষেত্রে নিজেরাই সুশাসন নিশ্চিত করে না। প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি আলম পলাশ বলেন, বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটা বড় ইস্যু। জলবায়ু পরিবর্তন সারা বিশ্বব্যাপী। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চাঁদপুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার প্রকল্পগুলোর কাজে সুশাসন নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। আমি মনে করি, আজকের এই আলোচনার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে। কান্ট্রি ফিশিং বোর্ড মালিক সমিতির সভাপতি শাহআলম মল্লিক বলেন, এসময়টাতে পদ্মা মেঘনায় প্রচুর পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত। কিন্তু নদীর নাব্যতা হ্রাস, ডুবোচর ও বিভিন্ন জায়গায় চর পড়ার কারনে ইলিশ মাছ তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জেলেরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন রাসেল বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারনে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। জেলা পরিষদ ইতিমধ্যে জলবায়ু তহবিলে প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে। গভীর নলকূপের একটা প্রকল্প থাকলেও ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় সেটিও বন্ধ করে দিয়েছে। শাহরাস্তি পৌরসভার সচিব তোফায়েল আহমেদ শেখ বলেন, ইতিমধ্যে শাহরাস্তি পৌরসভা জলবায়ু তহবিলে এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টাকার ১২টি প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। কাজের মানও ভালো হয়েছে। আগামী সপ্তাহে জলবায় ট্রাস্ট থেকে পরিদর্শনে আসবে। টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরাম চাঁদপুরের সভাপতি আল ইমরান শোভন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন প্রকল্প ফান্ডের যথোপযুক্ত ব্যবহার হয় না। অনেক অভিযোগ আছে। তবে জলবায়ু ফান্ডে কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি যাতে না হয় সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে সনাকের সাবেক সহ-সভাপতি মোঃ আব্দুল মালেক বলেন,জলবায়ু তহবিলে কিভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা দরর্কা। তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যেসকল প্রকল্প প্রহণ করা হয় তার পূর্বে সাধারণ জনগণের মতামত প্রহণ করা দরকার। মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন,জলবায়ু নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকবৃন্দ, বিভিন্ন পেশার জনসাধারণ, টিআইবি’র চট্রগ্রাম ক্লাস্টারের এরিয়া কোঅর্ডিনেটরবৃন্দ, সনাক চাঁদপুরের সদস্যবৃন্দ, জলবায়ু বিষয়ক জন অংশগ্রহণ কমিটি (সিসিপি) কমিটির সদস্যবৃন্দ, স্বজন, ইয়েস ও ইয়েস ফ্রেন্ডস গ্রুপের সদস্যবৃন্দ এবং টিআইবি কর্মীবৃন্দ।

Loading

শেয়ার করুন: