টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনটি সেবা প্রদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে : তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ একেএম মাহবুবুর রহমান

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চাঁদপুরের আয়োজনে ‘গভর্ন্যান্স চ্যালেঞ্জেস ইন হেলথ সেক্টর : টুওয়ার্ডস ইফেক্টিভ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ডেলিভারি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় কমিউনিটি মনিটরিং প্রতিবেদন Consultation on COVID-19 Vaccination Monitoring findings বিষয়ক মাল্টি স্টেক হোল্ডার সভা এবং গতকাল সনাক-টিআইবি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

সনাকের সহ-সভাপতি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক উপ-কমিটির আহ্বায়ক ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ একেএম মাহবুবুর রহমান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সনাকের সাবেক সভাপতি ও সদস্য কাজী শাহাদাত।

কমিউনিটি মনিটরিং প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সনাকের সহ-সভাপতি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক উপ-কমিটির আহ্বায়ক ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কোভিড-১৯ মহামারির অতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান শহর থেকে বিশ^জুড়ে করোনা মহামারির সূত্রপাত হলেও বাংলাদেশে সর্বপ্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ০৮ মার্চ ২০২০। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আবার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। সংক্রমণের ব্যাপকতা রোধে বাংলাদেশ সরকার মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে (১৩.৮২ কোটি) টিকা প্রদানের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিতকায় জানুয়ারি ২০২১ থেকে বাংলাদেশে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা প্রদান ছাড়াও বুস্টার ডোজ টিকা প্রদান কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। তথাপিও জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনতায় ঘাটতি, স্বাস্থ্যবিধি পালনে অনীহা, কোভিড-১৯ মোকাবিলা কার্যক্রমে সুশাসনের ঘাটতি এবং টিকা কার্যক্রমে অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ টিকা সরবরাহ ব্যবস্থা এবং টিকায় সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘গভর্ন্যান্স চ্যালেঞ্জেস ইন হেলথ সেক্টর : টুওয়ার্ডস ইফেক্টিভ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ডেলিভারি’ শীর্ষক একটি প্রকল্প (মেয়াদ : ০১ জুন ২০২১-৩১ ডিসেম্বর ২০২১) বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে টিআইবির ৪৫টি সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-এর কর্ম এলাকায় কমিউনিটি মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কমিউনিটি মনিটরিং-এর মাধ্যমে টিকা প্রদান কার্যক্রমে সেবাগ্রহীতাদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে সেবার মান, পর্যাপ্ততা, স্বচ্ছতা, দুর্বলতা এবং সংশ্লিষ্ট টিকা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা সম্পর্কে মতামত সংগৃহীত হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, টিকার নিবন্ধনে এখানকার ৬৪.১০% মানুষের অর্থ খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন। এছাড়া টিকা কার্ড প্রিন্ট করতে ও যাতায়াতের জন্যেও কিছু অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে বলে সেবাগ্রহীতারা জানিয়েছেন। টিকা কেন্দ্রে অব্যবস্থাপনার মুখোমুখি হয়েছেন বলে ২০.৫১% তথ্যদাতা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অব্যবস্থাপনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বলেছেন পাশর্^ প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্যে কোনো ব্যবস্থা নেই, অপর্যাপ্ত বসার স্থান ও অপর্যাপ্ত বুথ, সামজিক দূরত্ব না মানা, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্যে আলাদা কোনো সুবিধা না থাকা ও দীর্ঘ সিরিয়ালের কথা। টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে উত্তরদাতারা বলেছেন, এখানে তারা তেমন কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়নি। তবে কিছু তথ্যদাতা জানিয়েছেন, সিরিয়াল প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে (২০%)। এছাড়া সময়ক্ষেপণ ও দুর্ব্যবহারের কথাও তারা বলেছেন। টিআইবি আশা করে, প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে স্থানীয় পর্যায়ে টিকা প্রদান কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিসহ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠির অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণ এ বিষয়ে যৌথ ভূমিকা পালনে উদ্যোগী হবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ একেএম মাহবুবুর রহমান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্বে আমরা কোভিড-১৯ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। কোভিড-১৯ টিকা প্রাদান বিষয়ক টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনটি কোভিড সেবা প্রদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আমার কর্মক্ষেত্রে আপনারা আমার ভুলক্রটিগুলো দেখিয়ে দেবেন এটাই আমার প্রত্যাশা। আমি সবসময় টিআইবি ও সনাককে আমার বন্ধু হিসেবে দেখি। আমি মনে করি, যে আমার সমালোচক সে আমার বন্ধু। আমার ১৮ বছরের কর্মজীবনে এই প্রথম আমার কর্ম এলাকায় এমন একটি গবেষণা প্রতিবেদন দেখলাম। আমি দেখেছি প্রতিটি তথ্যই সঠিক। সুন্দর একটি গবেষণা উপস্থাপন করা হয়েছে। অধিকাংশই বাস্তব। তবে প্রতিবেদনে কর্মীদের কাজের চাপ বিবেচনা করা হয় নাই। স্বাস্থ্য কর্মীরা গত দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। করোনাকালীন সময়ে ডাক্তার, নার্স ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা যে পরিমান পরিশ্রম করেছেন সে পরিমান মূল্যায়ন তারা পায় নাই। নার্স ও পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সার্বক্ষণিক তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। কেউ দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করে নাই। তবে প্রতিবেদনে আর্থিক কোনো অনিয়মের কথা দেখি নাই। রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা অনেক পরিশ্রম করেছে। আমি লক্ষ্য করেছি, সেবা গ্রহিতাদের মধ্যেও সহনশীলতার অনেক অভাব রয়েছে। আমার আগে টিকা দিতে হবে এমন প্রবণতা অনেকের মধ্যেই ছিলো। নারী টিকা গ্রহণকারীদের জন্যে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থা ছিলো। ভবিষ্যতেও এ ধরনের আরও গবেষণা হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন। এ ধরনের গবেষণা কাজে আমার পক্ষ থেকে সকল সহযোগিতা থাকবে। তিনি এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য সনাক-টিআইবিকে ধন্যবাদ জানান।

টিআইবি’র এরিয়া কো-অর্ডিনেটর মোঃ মাসুদ রানার সঞ্চালনায় ও সনাকের সহ-সভাপতি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক উপ-কমিটির আহ্বায়ক ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন চাঁদপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ সাজেদা পলিন। প্রতিবেদনের উপর বক্তব্য উপস্থাপন করেন সিভিল সার্জন কার্যালয়ের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোঃ ইছারুহুল্লাহ। মুক্ত আলোচনা পর্বে বক্তব্য রাখেন আক্কাছ আলী রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ গোফরান হোসেন, চাঁদপুর রেলওয়ে কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ মাহমুদা খানম, জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ মহিউদ্দিন রাসেল, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবক টীমের সমন্বয়ক ওমর ফারুক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক প্রধান শিক্ষক বাসুদেব মজুমদার, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির বন্ধুত্ব বিভাগীয় প্রধান ওমর বিন ইউসুফ চৌধুরী, সনাক-চাঁদপুরের সিসিপি কমিটির সদস্য ব্যাংকার মুজিবুর রহমান, জেলা এনজিও সমন্বয় পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক পিএম বিল্লাল ও সনাকের ইয়েস গ্রুপের দলনেতা খায়রুল আলম। মুক্ত আলোচনা পর্বটি সঞ্চালনা করেন সনাকের সাবেক সভাপতি ও সদস্য কাজী শাহাদাত। এছাড়াও মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিকবৃন্দ, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সেবিকা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ, এনজিও প্রতিনিধিবৃন্দ, সনাক-চাঁদপুরের সদস্যবৃন্দ, এসিজি গ্রুপের সদস্যবৃন্দ ও ইয়েস গ্রুপের সদস্যবৃন্দ।

Loading

শেয়ার করুন: